আদিম মানুষ যখন কূপ, তড়াগ খনন করতে শেখেনি, তখন তারা নদীর ধারে বসবাস করত। নদীর সৃষ্টিমুখে বা পার্বত্যস্তরে যে জনগোষ্ঠীর সন্নিবেশ ঘটে, সেই জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে নদী সবেগে টেনে নিয়ে যায় সাগর সঙ্গমের দিকে। অর্থাৎ নদীর উজানে যে আদিম স্থুল সভ্যতা ও কৃষ্টির বিকাশ ঘটে, ভাটিতে তা পূর্ণতা পায় সূক্ষ সংস্কৃতির সভ্যতায়। দার্শনিক ঋষি শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর যে কিছু নিজ বৈশিষ্ট্য বা স্বকীয়তা রয়েছে- তা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মানবসভ্যতা ও নদীর অধিগমনের তত্ত্বটি সুন্দর ভাবে আমাদের সামনে উপস্থাপিত করেছেন। তিনি বিভিন্ন ক্ষেত্রে উদাহরণ সহযোগে দেখিয়েছেন- একটি নদী যে সংস্কৃতি-সভ্যতা বহন ক’রে অন্য নদীর ক্ষেত্রে সেটি হুবহু এক নয়। আবার দুটি নদী যখন মিলিত হয়, তখন তাদের মিলিত স্রোতধারা বহন ক’রে নিয়ে চলে আরেকটি তৃতীয় সভ্যতাকে। বীরভূমের কোপাই ও বক্রেশ্বর- এই দুই নদী তীরের মানুষের কথ্য ভাষা ও চালচলন একই হলেও হুবহু এক নয়- কিছু কিছু স্থানিক বৈশিষ্ট্য যেমন- উৎসব, অনুষ্ঠান ও জীবনধারনের প্রকরণে তা আলাদা বলেই লক্ষিত হয়। আবার নানুর থানার মেলানপুরে এসে নদীদ্বয় মিলিত হয়ে ‘কুয়ে নদী’ নাম নিয়ে এগিয়ে চলল- ও দুটি স্থানিক খন্ড সভ্যতা সর্বোতভাবে মিলে গিয়ে একটি নোতুন রূপ পরিগ্রহ করল- কথ্য ভাষাতেও একটি বিশেষ টান পাওয়া গেল।
ঠিক একই সূত্রে পড়েছে গাঙ্গেয় সভ্যতা, যমুনা সভ্যতা ও ব্রহ্মপুত্র সভ্যতা। গঙ্গা নদীর পার্বত্য স্তর শুরু হয়েছে গাঢ়োয়াল ও কুমায়ুন পর্বতমালায়। হরিদ্বারের কিছু আগে মন্দাকিনী ও অলকানন্দা মিলে গিয়ে- অর্থাৎ গাঢ়োয়ালী ও কুমায়ুনী সভ্যতা মিলে গিয়ে নোতুন বিমিশ্র গাঙ্গেয় সভ্যতার সূত্রপাত করল যার অধিক্ষেত্র প্রয়াগ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ঠিক তেমনিভাবে যমুনা সভ্যতা কয়েকটি খন্ড সভ্যতার সমবায়ে গড়ে উঠে প্রয়াগ পর্যন্ত প্রসারিত হ’ল। বিমিশ্র যমুনা সভ্যতা ও বিমিশ্র গাঙ্গেয় সভ্যতা প্রয়াগের সন্নিকটে মিলিত হয়ে বিমিশ্র গঙ্গা-যমুনা সভ্যতার সূত্রপাত করল যা কিনা বিস্তৃত ছিল বারানসী পর্যন্ত। অন্যদিকে ব্রহ্মপুত্র সভ্যতা আবার প্রাকসমচৈনিক সভ্যতার প্রাথমিক স্তর। তারপর তা ইন্দো-তিব্বতীয় সভ্যতার সাথে মিলিত হয়। অসম হ’ল চীন-তিব্বতীয় ও গাঙ্গেয় সভ্যতার বিমিশ্রিত রূপ। অসম গাঙ্গেয় সভ্যতার নিকটবর্ত্তী হওয়ার জন্যই এই বিমিশ্রনটা সম্ভব হয়েছিল। এইভাবে নদীর ধারা বেয়েই সভ্যতার সূত্রপাত ও পূর্ণতাপ্রাপ্তি।
শ্রী সরকার- নদী ও সভ্যতার এই তত্ত্বগত দিকটি পরিস্কারভাবে আমাদের সামনে উপস্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে একটি বিশেষ আলোকঝলমল দিকে তাঁর শুভ-বৈদূষ্য-শ্রীমন্ডিত দৃষ্টি ফেলেছেন যেটি তাবৎ বিদ্বৎ সমাজের জ্ঞানের অগোচরেই ছিল। সেটি হ’ল সমস্ত নদীসভ্যতা- তা সে একক বা বিমিশ্র- যাই হোক না কেন- পূর্ণতা পায় শেষ স্তরে বা ব-দ্বীপীয় স্তরে। তাই ব-দ্বীপীয় সভ্যতাই জ্ঞানে-বিজ্ঞানে-বৈদ্যূষ্যে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা পায়। প্রাকৃতির সেই উদার অকৃপন দানে বাঙালী সভ্যতা তাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সভ্যতা বলে দাবী করা যেতে পারে, কারণ তিনটি নদী সভ্যতার পরিনাম স্তর বা ব-দ্বীপ স্তর হ’ল বাঙালীস্তান। রাঢ়ীয় নদীসভ্যতার নদীগুলি – কাঁসাই, সুবর্নরেখা, রূপনারায়ণ, দ্বারকেশ্বর, দামোদর, শিলাবতীর মত অসংখ্য নদীর ব-দ্বীপ স্তর এই বাঙলা, গাঙ্গেয় নদীসভ্যতার ব-দ্বীপীয় স্তর (সাহেবগঞ্জ থেকে গঙ্গাসাগর) ও ব্রহ্মপুত্র নদীসভ্যতার ব-দ্বীপীয় স্তর বা পরিনতি (অধুনা বাংলাদেশের কক্সবাজার) হ’ল এই বাঙলার ভূমি। শ্রী সরকার জোরের সঙ্গে ঘোষনা করেছেন পৃথিবীর ইতিহাসে এমন উৎকৃষ্ট তিনটি ব-দ্বীপীয় সভ্যতার মহামিলনের আর কোন নিদর্শন নেই। বাঙালী তাই মঙ্গোলীয় (ব্রহ্মপুত্র নদী সভ্যতা বাহিত) প্রভাবে ভাব-প্রবন, আর্য (গঙ্গা বাহিত)প্রভাবে সংগ্রামী ও তেজস্বী আর রাঢ়ীয় প্রভাবে উদার, মেধাবী ও অন্তর্মুখী। বাঙলা তাই আর্যবর্ত্তের উপাঙ্গ নয়, মহাচীনের পরিশিষ্টাঙ্গও নয়, আবার অষ্ট্রীক-দ্রাবিঢ়ের একক পতাকাবাহীও নয়- গান্ডোয়ানাল্যান্ডের আদিম সংস্কৃতির (তথাকথিত আদিম রাঢ়ীয় জনগোষ্ঠীর বা নার্য সৃষ্ট) বিরুদ্ধে, গাঙ্গেয় উপত্যকার যে আদিম সংস্কৃতির উৎস ধারা (আর্য সৃষ্ট) তারও বিরুদ্ধে ও মৌল মোঙ্গলীয়ান সংস্কৃতি তারও বিরুদ্ধে- এই তিনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ক’রে সে একটা integrated Bengali culture বা সুমহান সুসংহত বাঙলা সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে।
শুধু কি তাই, পৃথিবীর যে সমস্ত প্রাচীন জাতি তাঁদের স্বকীয়তা বজায় রেখে ধরিত্রীকে মানবতার পাঞ্চজন্য শুনিয়েছে, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে-সাহিত্যে-সংস্কৃতিতে মানুষের বাঁচার আকুতিকে মাধুর্যে ভরিয়ে দিয়েছে- তাদের মধ্যে বাঙালী প্রাচীনতম। শ্রী সরকার বলেছেন- “কে আগে কে পরে- এই নিয়ে বিশদ আলোচনা না করেও বলতে পারি- রাঢ়ভূমিতে মানুষের উদ্ভব অতি প্রাচীন, এর চেয়ে প্রাচীনতম মানুষ্য-নিবাসের কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি।” শুধু প্রাচীনত্বের শিরোপাই নয়, সভ্যতা-সংস্কৃতির আলো পৃথিবীর বুকে বাঙালীই জ্বেলেছিল ও বসুধৈবকুটুম্বকম-এর আদর্শ বাঙালীই প্রচার করেছিল। শ্রী সরকার বাঙলার মাঠ-ঘাট-প্রান্তর থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান সংগ্রহ ক’রে প্রমান করেছেন- বৌদ্ধ শাস্ত্রে আছে কপিলাবস্তুর রাজপ্রাসাদে রাজা শুদ্ধোধন তনয় শাক্যসিংহ বাংলা ভাষার চর্চা করতেন। বৌদ্ধ ইতিহাস ২৫০০ বছরের পুরানো। তার মানে বাংলা ভাষা যে তিন হাজার বছরের পুরানো তা নিয়ে সন্দেহ নাই। আর মেগাস্থিনিষ এই ভাষা সমৃদ্ধ জাতিকে ‘গঙ্গা রিডি’ জাতি নামে অভিহিত করেছেন। চার পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন রোমক লিপিতে বাংলাকে ‘বাঞ্জাল’ ও প্রাচীন চীনা লিপিতে ‘বাঞ্জালা’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। সুতরাং বাঙালী জাতি পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি পুরানো।
শ্রী সরকার ভাষাবিজনানীদের কাছে বাংলা ও সংস্কৃত ভাষা নিয়ে তার জোরালো মত ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন বাংলা ভাষায় শতকরা ৯২টি শব্দ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সংস্কৃত সঞ্জাত। সংস্কৃত যদি বিদেশি ভাষা হত তাহলে রাঢ়ের কথ্য ভাষায় এত সংস্কৃত শব্দ থাকত না। গৃহবধূ যখন বলেন- ‘বিনা তেলে রাঁধতে পারবো না’- এর প্রতিটি শব্দই সংস্কৃত থেকে এসেছে। সুতরাং সংস্কৃত ভাষার জন্ম এই রাঢ়ভূমিতেই। আর সংস্কৃত সাহিত্যই পৃথিবীতে সভ্যতার ঊষা এনেছিল।
সুতরাং বাঙালী নামধেয় জনগোষ্ঠী হটাৎ জেগে ওঠা, নোতুন বাউন্ডারী পাওয়া রাষ্ট্রকেন্দ্রীক জনগোষ্ঠী নয়, এর রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভাঙ্গাগড়া অনেকবার হয়েছে, কিন্তু জনগোষ্ঠীটি অনেক দিনের।।
লেখস্বত্ব © ২০২১ আমরা বাঙালী - সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত।