রাঢ়ের উপভাষাগুলি তথা বাংলা ভাষার উচ্চারণেও অনেকগুলি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বৈশিষ্ট্যগুলি মোটামুটি বিচারে যজুর্বেদীয় রীতিসম্মত। ‘অ’ অক্ষরটির ইংরাজী ‘a’ অক্ষরের মত একুশ প্রকারের উচ্চারণ না থাকলেও ভারতে মুখ্যতঃ তিন প্রকারে উচ্চারিত হয়ে থাকে- (১) সংবৃত, (২) বিবৃত, (৩) তির্যক। সংবৃত রীতিতে ‘অ’ অক্ষরটির উচ্চারণ ইংরাজী authentic শব্দের ‘au’-য়ের উচ্চারণের মত। আর বিবৃত রীতিতে ‘অ’-য়ের উচ্চারণ কতকটা ইংরাজী ‘but’ শব্দের ‘u’-য়ের মত। আর তির্যক রীতিতে ‘অ’-য়ের উচ্চারণ কতকটা ইংরাজী ‘origin’ শব্দের ‘o’-য়ের মত। বাংলা ভাষায় সংবৃত ও তির্যক এই দুটি উচ্চারণই প্রচলিত, বিবৃত ব্যবহার নেই।
‘ণ’-য়ের উচ্চারণ বাংলাতে যজুর্বেদীয় রীতিসম্মত (নঁ), ঋগ্বেদীয় ‘ঢঁ’-য়ের মত নয়। বাংলা অন্তঃস্থ ‘ব’ ও বর্গীয় ‘ৰ’ –য়ের উচ্চারণ একই ধরণের।বাংলা অন্তঃস্থ ‘য’ ও অন্তঃস্থ ‘য়’-এর উচ্চারণে “পদান্তে পদমধ্যস্থে য-কার ‘ইঅ’ উচ্যতে” অর্থাৎ শব্দের প্রথমে থাকলে অন্তঃস্থ ‘য’ কতকটা বর্গীয় ‘জ’–য়ের (লঘু বর্গীয় ‘জ’) মত উচ্চারণ হয় কিন্তু মধ্যে ও অন্তে থাকলে ‘ইঅ’ উচ্চারণ হয়। অন্তঃস্থ ‘য়’ অক্ষরটির মত ‘ড়’ ও ‘ঢ়’ –ও একই নিয়মে চলে। অন্যান্য অন্তঃস্থ বর্ণের মধ্যে ‘র’ ও ‘ব’ (উঅ) তাদের অন্তঃস্থ ও অন্-অন্তঃস্থ ভেদ হারিয়ে ফেলেছে। বাংলায় অন্তঃস্থ ‘ল’ (ল)–য়ের কোন উচ্চারণ নেই। বাংলায় দন্ত্য ‘স’–এর উচ্চারণ নেই বললেই চলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তালব্য ‘শ’–এর উচ্চারণ চলে। মূর্ধণ্য ‘ষ’–এর স্বতন্ত্র উচ্চারণ নেই কিন্তু ‘ক’-এর পাশে থাকলে যজুর্বেদীয় রীতিসম্মতভাবে ‘ক্ষ’ –য়ের মত উচ্চারণ। অসমিয়া ও পাঞ্জাবীতে কিন্তু সর্বাবস্তাতেই মূর্ধন্য ‘ষ’-এর উচ্চারণ মূর্ধন্য ‘খ’-এর মত।
মহাপ্রাণ ও হীনপ্রাণের উচ্চারণে বাংলা ভাষায় মহাপ্রাণকে খুব বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয় না। বস্তুতঃ শেরশাহাবাদিয়া উপভাষা ব্যতিরেকে অন্য কোন উপভাষাতেই মহাপ্রাণের পূর্ণ উচ্চারণ নেই। চট্টল ও আরও কয়েকটি উপভাষায় মহাপ্রাণের উচ্চারণ নেই বললেই চলে। কলিকাতা শব্দের উচ্চারণে শব্দের আদিতে থাকলে মহাপ্রাণের পুরো উচ্চারণ রয়েছে; যেমন ‘ছেলে’, ‘ঢাকা’, ‘ঝালানো’, ‘থালা’, ‘ধামা’ প্রভৃতি। কিন্তু মধ্যে ও অন্তে থাকলে তা সংশ্লিষ্ট হীনপ্রাণে রূপান্তরিত হয়- যেমন, ‘মাছ’ (মাচ), ‘মাঝ’ (মাজ), ‘কথা’ (কতা), ‘সাধ’ (সাদ) প্রভৃতি।
পূর্ণ উচ্চারণ ও হসন্ত উচ্চারণ – বাংলা ভাষায় মূখ্যতঃ সকল অক্ষরের পূর্ণ উচ্চারণ হয়। তবে কিছু কিছু ব্যতিক্রমও আছে। যেমন ‘শিব’ (শিব্), ‘রাম’ (রাম্), ‘রূপ’ (রূপ্) প্রভৃতি। এ ব্যাপারে মোটামুটি নিয়মটি হচ্ছে-
(১) শব্দের আদিতে, মধ্যতে ব্যঞ্জনের পুরো উচ্চারণ হয় কিন্তু শেষে থাকলে হসন্ত উচ্চারণ হয়, যেমন ‘রূপ’ (রূপˎ) কিন্তু ‘রূপবাণী’-র ‘রূপˎবাণী’ উচ্চারণ হৰে না। কারণ, এক্ষেত্রে ‘প’ আর অন্তে নেই, মধ্যে এসে গেছে। তাই উচ্চারণ হৰে ‘রূপ্-অ-বাণী’, ‘শিব’ (শিব্) কিন্তু ‘শিব্-অ-রাম’ (শিবরাম), শিব্-প্র-সাদ’ (শিবপ্রসাদ)।
(২) যুক্তাক্ষর থাকলে তার পূর্ণ উচ্চারণ হৰে, হসন্ত উচ্চারণ হবে না। যেমন, ‘কণিষ্ক’ (‘কণিষˎকˎ’ উচ্চারণ হৰে না), ‘দেবদত্ত’ (‘দেবদৎ’ উচ্চারণ হৰে না), ‘বৈদ্য’ (‘বৈদˎ হৰে না) প্রভৃতি।
(৩) যুক্তাক্ষর না থাকলেও শব্দটি কৃদন্তে ‘ক্ত’ প্রত্যয়ান্ত অথবা তদ্ধিতার্থে ‘ত’ প্রত্যয়ান্ত হয় তাহলে তাদের পূর্ণ উচ্চারণ হৰে । যেমন ‘সম্মত’ (‘সম্মৎ’ নয়), ‘গৃহীত’ (‘গৃহীৎ’ নয়), ‘স্থগিত’ (‘স্থগিৎ’ নয়), ‘আলোচিত’ (‘আলোচিৎ’ নয়), ‘দীর্ঘায়িত, (‘দীর্ঘায়িৎ’ নয়) প্রভৃতি।
(৪) ‘ক্ত’ বা ‘ত’ প্রত্যয়ান্ত না হলেও অযুক্তাক্ষর (non-dipthong) ক্ষেত্রে পুরো উচ্চারণ হৰে যদি সংশ্লিষ্ট অক্ষরের পূর্বে অনুস্বার, বিসর্গ, ঐ-কার ও ঔ-কার থাকে- যেমন ‘কংস’ (‘কংস্’ নয়), ‘বংশ’ (‘বংশ্’ নয়), ‘সিংহ’ (‘সিংহ্’ নয় ), ‘দুঃখ’ (‘দুখ্’ নয়), ‘নিঃস্ব’ (‘নিস্’ নয়), ‘জৈন’ (‘জৈন্’ নয়), ‘গৌণ’ (‘গৌ্ণ্’ নয়), ‘সৌধ’ (সৌধ্ নয়)। এছাড়া যেখানে সংস্কৃত ব্যঞ্জনের স্থানে বিবর্ত্তনের ফলস্বরূপ স্বরবর্ণের আগম হয়েছে, উচ্চারণগত পার্থক্য না থা্কলেও ঐ-কার বা ঔ-কারের পরিবর্ত্তে ‘ই’ বা ‘উ’ –এর ব্যবহার হওয়াই বাঞ্ছনীয়। ঈ ও ঊ-এর উচ্চারণ বাংলায় না থাকায় এখানে উল্লেখ্য নয়। দধি > দহি > দই (‘দৈ’ নয়), বধূ > বহু > বউ (‘বৌ’ নয়), মধু > মহু > মউ (‘মৌ’ নয়), ‘মউমাছি’ (‘মৌ্মাছি’ নয়)।
(৫) যে সকল শব্দ ‘ড’ প্রত্যয়ের দ্বারা নিষ্পন্ন হয় তাদেরও পূর্ণ উচ্চারণ হৰে। যেমন- ‘জলদ’ (‘জলদ্’ নয়), ‘ৰরদ’ (‘ৰরদ্’ নয়), ‘অমিতাভ’ (‘অমিতাভ্’ নয়), ‘দ্রুতগ’ (‘দ্রুতগ্’ নয়) প্রভৃতি।
লেখস্বত্ব © ২০২১ আমরা বাঙালী - সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত।