১৯৫৫ সালের বঙ্গ-বিভাগের সময় ওড়িষ্যার খনিজ সম্পদে পূর্ণ দুটি করদ রাজ্য খরসুনা ও সেরাইকেল্লাকে বিহারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এই অন্তর্ভুক্তির বিরুদ্ধে স্থানীয় অধিবাসীদের পক্ষ থেকে তীব্র আন্দোলন উঠেছিল। এই দুটি রাজ্যই বাংলা ভাষাভাষী প্রধান। বিহারের তৎকালীন কংগ্রেসী মুখ্যমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ সিং গুলি চালিয়ে সেই আন্দোলন দমন করেছিলেন। গুলিতে বহু স্থানীয় অধিবাসী নিহত হয়েছিলেন। ছোটনাগপুরের বাঙালী অধ্যুষিত পাঁচটি জেলা- মানভূম, ধলভূম, সিংভূম, রাঁচি ও হাজারিবাগ জেলাকে বিহার প্রদেশের মধ্যেই রাখা হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে মানভূম জেলার কংগ্রেসীরা কংগ্রেস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ‘লোকসেবক সঙ্ঘ’ নামে একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করেন ও মানভূম জেলাকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করার জন্যে ক্রমাগত আন্দোলন চালাতে থাকেন। ১৯৫২ সালের নির্বাচনে ‘লোকসেবক সঙ্ঘ’ বিধানসভায় ১০ টি ও লোকসভায় ২ টি আসন লাভ করে। নির্বাচনের সাফল্যের পর ‘লোকসেবক সঙ্ঘ’-এর এক হাজার কর্মী মানভূম থেকে কলিকাতায় পদব্রজে উপস্থিত হন ও তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বিধান চন্দ্র রায়ের সঙ্গে সাক্ষ্যাৎ করে মানভূম কে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভূক্ত করার জন্য দাবী জানান। মানভূমের অধিবাসীদের শতকরা ৯৭ জন বাঙালী। তাঁদের ভাষা, আচরণ, লৌকিক জীবন সবই বাঙলার মূল ধারার সঙ্গে যুক্ত।
পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে মানভূমেকে অন্তর্ভূক্ত করার দাবী ও আন্দোলন উত্তরোত্তর তীব্র আকার ধারণ করতে শুরু করল। ১৯৫৫ সালে হৃদয়নাথ কুঞ্জরু, পানিক্কর ও ফজল্ আলীকে নিয়ে সীমানা কমিশন তৈরী করা হয়েছিল। ওই কমিশনের সামনে মানভূমের স্থানীয় অধিবাসীরা মানভূমের বঙ্গভূক্তির সমর্থনে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। কিন্তু সীমানা কমিশনের সামনে কর্তৃপক্ষ ভূল মানচিত্র ও অন্যান্য বিকৃত তথ্য পরিবেশন করলেন আর সেই বিকৃত তথ্য ও মানচিত্রের ওপর ভিত্তি ক’রে সীমানা কমিশন মানভূমের পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্ভূক্তিকে বাতিল করলেন। কিন্তু আন্দোলনের তীব্রতাকে স্মরণ ক’রে মানভূম জেলার শুধু পুরুলিয়া মহকুমাকে (কৃষজ ও খনিজ সম্পদহীন) পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাব দিলেন কিন্তু মানভূমের খনিজ ও কৃষিজ সম্পদে পূর্ণ অপর মহকুমা ধানবাদকে বিহারের সঙ্গে যুক্ত ক’রে দিলেন।
মানভূম ছাড়াও ধলভূম, সিংভূম, রাঁচি ও হাজারিবাগ জেলায় গড়ে শতকরা ৮৫ জনেরও বেশী মানুষ বাঙালী (১৯৫১ সালের আদম সুমারীর রিপোর্ট অনুযায়ী) পশ্চিমবঙ্গ সংলগ্ন এই সব জেলায় ভাষা বাংলা ও লৌকিক সংস্কৃতি, লোকাচার, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, পোশাক পরিচ্ছদ- এক কথায় সবই বাঙলার মূল জীবনধারার সঙ্গে যুক্ত ও এখনও তা অব্যাহত আছে। এই সব জেলার অধিবাসীরাও দাবী জানিয়েছিলেন ধলভূম, সিংভূম ও রাঁচি জেলার একাংশকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য। ‘ধলভূম মুক্তি সমিতি’ নামে একটি সংঘটন তৈরী হয়েছিল এই দাবীর ভিত্তিতে। স্থানীয় শ্রীযুক্ত কিশোরী মোহন উপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ধলভূম এর বঙ্গ ভুক্তি আন্দোলন শুরু হয়। ‘ধলভূম মুক্তি সমিতি’র ১৭৫ জন সদস্য ধলভূম থেকে পদব্রজে কলিকাতায় এসে বিধান রায়ের কাছে স্মারক লিপি পেশ করেছিলেন। সীমানা কমিশনের কাছে উপস্থাপিত বিকৃত তথ্যের ভিত্তিতে ধলভূমের বঙ্গভূক্তির দাবী সরাসরি নাকচ হয়ে গেল। সিংভূমের দাবীকেও সীমানা কমিশন ধূলিসাৎ ক’রে দিলেন।
এরপর ১৯৫৬ সালে রাজ্যসীমা সংক্রান্ত সমস্যা ও বিরোধ মেটাবার প্রয়োজনে নতুন ক’রে ‘সিলেক্ট কমিটি’ ঘটিত হয়। এই কমিটিতে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নেহেরু, বিধান চন্দ্র রায়, শ্রীকৃষ্ণ সিং, হৃদয়নাথ কুঞ্জরু ও পানিক্কর। সিলেক্ট কমিটির কাছেও পূর্ব পরিকল্পনা ও চক্রান্ত মাফিক বিকৃত মানচিত্র সমেত ভুল তথ্য পরিবেশন করা হয়েছিল। সেই মানচিত্র ও তথ্যের ভিত্তিতে ধলভূম ও সিংভূম সমেত রাঁচি, হাজারিবাগের পশ্চিমবঙ্গ ভুক্তির দাবী অগ্রাহ্য হয়ে গেল। সিংভূম জেলার শতকরা ৯৬ জন অধিবাসীই বাঙালী। ভাষা-লোকাচার-সংস্কৃতি সবদিক থেকেই সিংভূম বাঙলার ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত। সিংভূমের খনিজ সম্পদ বিপুল; লৌহ-ম্যাঙ্গানিজ ও অন্যান্য বিবিধ সম্পদে সিংভুম ভরপুর। তাই সিলেক্ট কমিটি সিংভুমের বঙ্গভুক্তি বাতিল ক’রে দিলেন আর সিংভুমের বঙ্গভুক্তির বিরুদ্ধে নেহেরু যুক্তি দিলেন টাটা ইস্পাত কারখানার অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য জামসেদপুরের খনিজ সম্পদপূর্ণ অঞ্চলগুলিও জামসেদপুরের সঙ্গে থাকা প্রয়োজন। বিধান রায় জহরলাল নেহেরুকে খুশি করার জন্য এই যুক্তিকেই মেনে নিলেন। সিংভূমের বঙ্গভুক্তির কোন চেষ্টাই করলেন না। সিংভূম ও ধলভূম, খনিজ ও বনজ সম্পদে ভরপুর। পটমদা, চান্ডিল, ইছাগড়, চন্দনকেয়ারীর কয়লাখনি বিখ্যাত। এর সঙ্গে আছে যাদুগড়িয়ার ইউরেনিয়ম খনি, মুসাবনীর তামার খনি ও জামসেদপুরের শিল্পনগরী। এখানকার অধিবাসীদের শতকরা ৮৮ জন বাঙালী (১৯৩১ সালের আদমসুমারীর রিপোর্ট)। বাংলা ভাষা ও বাঙলার কৃষ্টির সঙ্গে এখানকার অধিবাসীরা ওতঃপ্রোতভাবে যুক্ত। কিন্তু বাঙলাকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার অসৎ উদ্দেশ্যেই বাঙলার সমস্ত দাবীকে ‘সিলেক্ট কমিটি’ বাতিল ক’রে দিলেন।
ভারতীয় সংবিধানের প্রথম অধ্যায়ে ‘ভারতের ইয়ূনিয়নসমূহ ও তার অঞ্চসমূহ’ সম্পর্কে ৩নং ধারায় পর পর কয়েকটি অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- কেন্দ্রীয় সংসদ প্রয়োজনে রাজ্যগুলির সীমানা পুনর্ঘটন করতে পারে, একাধিক রাজ্যকে একত্র ক’রে একটি রাজ্যে পরিণত করতে পারে, কোন রাজ্যের বিশেষ বিশেষ অঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন ক’রে অন্য অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত করতে পারে ও দরকার মনে করলে রাজ্যের সীমানা বর্দ্ধিত, পরিবর্তিত ও লুপ্ত করতে পারে, এমন কি নোতুন রাজ্যও সৃষ্টিও করতে পারে। সংবিধানের এই ৩নং ধারাকে প্রয়োগ করেই অন্ধ্রপ্রদেশ, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, নাগাল্যান্ড, মধ্যপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, পঞ্জাব, হরিয়ানা, অরুনাচল, মেঘালয়, মিজোরাম প্রভৃতি রাজ্যগুলি সৃষ্টি করা হ’ল। এর জন্য বহুবার সংবিধানকে সংশোধন করতে হয়েছে। কিন্তু বাঙলার দাবী আজও উপেক্ষিত রয়েছে।
লেখস্বত্ব © ২০২০ আমরা বাঙালী - সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত।