[[ দার্শনিক শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকারের “ৰাঙলা ও ৰাঙালী” গ্রন্থের অনুসরণে তথা “….” চিহ্নের মধ্যবর্ত্তী অংশ উক্ত গ্রন্থ থেকে সরাসরি উদ্ধৃত করা হয়েছে।]]
পৃথিবীর মানচিত্রে ভূ-খন্ডগত উৎপত্তির স্বতন্ত্রতা, বিস্ময়কর জলবায়ুর আনন্দচ্ছলতা, বৈচিত্রপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য্যতা তথা সর্বোত্তম বিমিশ্র সভ্যতার ক্রমবিকাশের নীরিখে, বাঙলা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ।
“বাঙলা আর্য্যাবর্ত্তের উপাঙ্গ নয়, বাঙলা মহাচীনের পরিশিষ্টাঙ্গও নয়, আবার বাঙলা অষ্ট্রিক-দ্রাবিড়ের একক পতাকাবাহীও নয়। বাঙলার পরিচিতি তার নদীমাতৃক অস্তিত্বে প্রাণোচ্ছল। সে তার নিজের পরিচয়েই স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাঙলা বাঙলা-ই।”
“আমাদের এই বাঙলার প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী নাম হচ্ছে ‘গৌড়দেশ’। এককালে এই দেশ গুড় উৎপাদনে সারা বিশ্বে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিল বলে একে ‘গৌড়দেশ’ নাম দেওয়া হয়েছিল। এই দেশ পঞ্চগৌড় নামেও প্রসিদ্ধ ছিল। তার কারণ এর ছিল পাঁচটি মৌলিক বিভাজন। পঞ্চগৌড় অর্থাৎ গৌড়দেশ বা বাঙলার প্রথম ও সর্ববৃহৎ ছিল রাঢ়। গৌড়দেশের দ্বিতীয় অংশ সমতট- যার সাধারণ বাংলা নাম বাগড়ি। বাঙলার তৃতীয় অংশ বরেন্দ্র (বরীন্দ্), চতুর্থ অংশ বিদেহ বা মিথিলা বা তিরহুত ও সর্বশেষ অতিমাত্রায় নদীমাতৃক অংশ বঙ্গ বা ডবাক।”
১) রাঢ় – সুপ্রাচীন গন্ডোয়ানাল্যান্ডের অর্থাৎ বৈদিক যুগের জম্বুদ্বীপে আর সুবর্ণদ্বীপের প্রত্যন্ত সীমায় ছিল বাঙালী সভ্যতার আদি ভূমি- ত্রিশ
কোটি বছরের পুরোনো রাঢ়ভূমি।
“পুরোনো গন্ডোয়ানাল্যান্ড… সুদূর অতীতে যখন ভারতবর্ষ ছিল না, উত্তর ভারত ছিল না, অথবা বাঙলার ডবাক, সমতট অঞ্চল ছিল না, সেই সময় যে গন্ডোয়ানাল্যান্ড ছিল- আজ থেকে প্রায় ত্রিশ কোটি বছর আগে- তখন সিন্ধু, পঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ, বিহার ও বাঙলার অধিকাংশই ছিল না। সেগুলো ছিল সমুদ্রের তলদেশে। হিমালয়ও ছিল না, কিন্তু বিন্ধ পর্বত ও তার শাখা-প্রশাখা সাতপুরা, সহ্যাদ্রি, রাজমহল, রামগড়- এই পাহাড়গুলো ছিল। তারা ছিল অতি বৃহৎ, অতি উচ্চ, আর ছিল তুষারাবৃত। এই তুষারাবৃত হওয়ার ফলে ওদের থেকে যে নদীগুলো বেরুত তারা বার মাস বরফ গলা জলে ভরে থাকত, কোন কালেও শুকোত না। সুবর্ণরেখা, কংসাবতী, কেলেঘাই, হলদি, রূপনারায়ণ, দ্বারকেশ্বর, শীলাবতী, জয়পান্ডা, গন্ধেশ্বরী, দামোদর, অজয়, ময়ূরাক্ষী- এরা হল সেই গন্ডোয়ানাল্যান্ড থেকে বেরিয়ে আসা নদী। রাঢ়ের ঢাল পশ্চিম থেকে পূর্বে। তাই নদীগুলোর গতি পশ্চিম থেকে পূর্বে।”
“রত্নগর্ভা সুপ্রাচীন রাঢ় ছিল মহাসমুদ্র-ঘেরা পর্বতমালার সমন্বয় যে আদ্রিবলয় একদিন ঝড়-ঝঞ্চায়, অশনি-সম্পাতে মুখরিত থাকত। মানুষ ছিল না, অন্য কোন প্রাণীও ছিল না- লতা গুল্মও ছিল না। একমাত্র পরমপুরুষ ছাড়া রাঢ়ের সেই অপূর্ব সৌন্দর্যের আর কেউ সাক্ষী ছিল না। পাহাড় গুঁড়িয়ে গুঁড়িয়ে চুর্ণ-বিচুর্ণ হয়ে পাহাড়ের মাঝে মাঝে দেখা দিল সমতল উপত্যকা ও অধিত্যকা। নদীগুলি বয়ে নিয়ে চলল পলিমাটি ও বালি।
এই অবক্ষয়ীত পর্বতমালা হয়ে গেল একালের রক্তমৃত্তিকা। এদের নদীবাহিত বালি-পলি থেকে গড়ে উঠল রাঢ়ের পূর্বাংশ….।”
“…মুখ্যতঃ ঢেউ লাল মাটির দেশ বা রক্তমৃত্তিকার দেশ এই অর্থে অষ্ট্রিক ভাষায় ‘রাঢ়ো’ শব্দ থেকে রাঢ় শব্দটি এসেছে। ভাগীরথীর পশ্চিম তীর অর্থাৎ আজকের মেদিনীপুর, হাওড়া, হুগলী, বর্দ্ধমান, বীরভূম, বাঁকুড়া, পশ্চিম মুর্শিদাবাদ বা রাঢ় মুর্শিদাবাদ, দুমকা, সাহেবগঞ্জ, দেবঘর, গড্ডা, ধানবাদ, পুরুলিয়া, সিংভূম, ভঞ্জভূম, রাঁচীর পূর্বাংশ, গিরিডির দক্ষিণ-পূর্বাংশ নিয়ে তৈরী আমাদের এই রাঢ় দেশ। মানব সভ্যতার আদি ভূমি…।”
২) সমতট বা ৰাগড়ি – “বাঙলার দক্ষিণাংশ সংস্কৃতে যাকে ‘সমতট’ বলা হয়, তাঁর বাংলা নাম ‘ৰাগড়ি’। ৰাগড়ি মানে যে অংশ ৰঙ্গ-ডবাকের পশ্চিমে, বরেন্দ্রর দক্ষিণে ও রাঢ়ের পূর্বে অবস্থিত। ৰাগড়ির উত্তরে গঙ্গা-পদ্মা, পূর্বে মধুমতী, পশ্চিমে ভাগীরথী ও দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর।”
রাঢ়ের পূর্বে ছিল ‘সারগাসো’ সমুদ্র। রাঢ় তৈরী হবার কয়েক লক্ষ বছর পরে, সম্ভবতঃ মানুষের আবির্ভাবের পরে তৈরী হয়েছিল অবশিষ্ট বাঙলা; তবে খুব পরে নয়- ওলিগোসিন ও মেসাজোয়িক যুগের মধ্যবর্ত্তী কোন সময়ে, পশ্চিম রাঢ় ও পূর্ব রাঢ়ের নদীগুলির দ্বারা বাহিত পলি-বালিতে দক্ষিণ দিক থেকে তৈরী হয়েছিল সমতট। সমতটের মৃত্তিকা অত্যুর্বর। অল্পকালেই সেখানে গজিয়ে উঠেছিল সবুজ অরন্যানী।
“সমতটের আকার আনেকটা ত্রিভুজের মত। ‘ডেলটা’ অক্ষরটিও ত্রিভুজের মত দেখতে, বাংলা ‘ব’ অক্ষরটিও ত্রিভুজের মত দেখতে। তাই ইংরাজীতে একে বলা হয় ‘ডেল্টা’, বাংলায় বলা হয় ‘ব-দ্বীপ’। এই ব-দ্বীপের সূত্রপাত মুর্শিদাবাদ জেলার সুতী থানার ছাপঘাটি গ্রামে যেখানে পদ্মা থেকে ভাগীরথী বহির্গত হয়েছে।”
সমতট বলতে বোঝায় বর্ত্তমান পূর্ব মুর্শিদাবাদ (বাগড়ি মুর্শিদাবাদ), নদীয়া, উত্তর ২৪ পরগণা, দক্ষিণ ২৪ পরগণা, কলিকাতা, খুলনা, যশোর, কুষ্ঠিয়া, গোয়ালনন্দ, গোপালগঞ্জ, পটুয়াখালি প্রভৃতি।
৩) বরেন্দ্র (বরীন্দ)- প্রত্নজীবক বা পলিওজোইয়িক যুগের শেষ পর্বে, আজ থেকে ত্রিশ কোটি বৎসর পূর্বে জলমগ্ন পৃথিবী-পৃষ্ঠে বিরাজমান পার্বত্য ঊষর ভূমির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘রাঢ়’ দেশ অর্থাৎ রক্তমিত্তিকার দেশ। রাঢ়ের জন্মের বহু কোটি বৎসর পরে এক বিরাট আগ্নেওগিরি সঞ্জাত ভূমিকম্পের ফলে, পাতাল থেকে টেথিস সাগর ফুঁড়ে উত্থিত হ’ল হিমালয় পর্বতমালা। হিমালয় থেকে জন্ম নেয় হিমালয়-দুহিতা গঙ্গা ও হিমালয়-তনয় ব্রহ্মপুত্র। তাদের পলি বালিতেই তৈরী হয়েছিল ‘বরেন্দ্র’।
“পঞ্চ গৌড়ের অন্যতম এই বরেন্দ্র ভূমির উত্তরে হিমালয়, দক্ষিণে গঙ্গা-পদ্মা, পূর্বে যমুনা ও নূতন ব্রহ্মপুত্র আর পশ্চিমে কোশী নদীর পুরোনো খাত।।….বাঙলার উত্তরাংশকে বরেন্দ্র বলা হয়। ….এই বরেন্দ্রভূমি এককালে মোটামুটি বিচারে দু’টি ভুক্তিতে বিভক্ত ছিল। উত্তরাংশে ছিল কামতাপুর ভুক্তি; যার অন্তর্ভুক্ত ছিল পূর্বতন গোয়ালপাড়া জেলা, বর্তমান জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, রংপুর জেলা, দিনাজপুর (উত্তর/দক্ষিণ) জেলা, দার্জিলিং জেলার সমতল অংশ, কিষাণগঞ্জ ও নেপালের ঝাঁপা জেলা ; আর ছিল পৌন্ডবর্ধন ভুক্তি- যার অন্তর্ভুক্ত ছিল বর্তমানের বগুড়া, পাবনা, রাজশাহী, মালদা প্রভৃতি জেলা।”
৪) বিদেহ বা মিথিলা – প্রায় দশ লক্ষ বছর আগে প্লিষ্টোসিন উপযুগে রাঢ় ভূমির অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশে, পৃথিবী গ্রহের প্রথম মানবের আবির্ভাব ঘটে। তার কয়েক লক্ষ বছর পরে তৈরী হয় মিথিলার মাটি।
“….তারপর হিমালয় থেকে বারিয়ে নেবে আসতে লাগল একে একে বহু নদী- গ্নগা, যমুনা, ঘর্ঘরা, তাপ্তী, কোশী। তাদের বাহিত পলিতে তৈরী হ’তে লাগল উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ সমতল ভূমি। এই হ’তে হ’তে বাঙলাও সেই পলিতে তৈরী হ’ল। এই পলির সঙ্গে যুক্ত হ’ল রাঢ়ের সেই পুরোনো মাটি, যা গন্ডোয়ানাল্যান্ডের পাহাড়গুলো থেকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে নেবেছিল….।”
নারায়নী-গণ্ডক অববাহিকার পূর্ব তীরে বিদেহ বা মিথিলা ত্রিহুত। রাজা মিথি কর্তৃক ধৃত বা বাহিত ইত্যর্থে মিথি + লা + ড + স্ত্রিয়ম্ ‘আ’ = মিথিলা।
“পদ্মা বা গঙ্গার উত্তর তীরে, কিন্তু কোশী নদীর পশ্চিম তীরে গৌড় দেশের যে অংশ তার নাম বিদেহ বা মিথিলা (মিথি+লা+দ+টা অর্থাৎ রাহা মিথি যে দেশ জয় করেছিলেন) বা ত্রিহুত বা তিরভূমি। ….এই ত্রিহুত জেলাটি ছিল আয়তনে বেশ বড়। ইংরেজরা একে দু’টুকরো করে…. পূর্বাংশের নাম দেন দারভাঙ্গা…. …আর দারভাঙ্গা জেলা থেকে হয়েছে মধুবনী…, দারভাঙ্গা… ও সমস্তীপুর…।”
৫) ৰঙ্গ (ডবাক) – “বরেন্দ্র ও সমতটের পূর্ব দিকে গৌড় দেশের অতিমাত্রায় যে নদীমাতৃক অংশ তার নাম ছিল ৰঙ্গ (ডবাক)। …. কিন্তু বিশেষার্থে ‘ৰঙ্গ’ বা ‘বঙ্গ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে দবাক অঞ্চল। অর্থাৎ যে এলাকার উত্তরে বর্ত্তমানে মেঘালয় (মেঘালয়ের গাড়ো পাহাড় এলাকাটি একসময় ময়মনসিংয়ের সুষঙ্গ রাজ্যের অধীন ছিল), পূর্বে কখনও মেঘনা, কখনও আরাকান ইওমা (পর্বত), দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর ও পশ্চিমে মধুমতী ও যমুনা।”
পঞ্চগৌড়ের অতিমাত্রায় নদীমাতৃক অংশ বলতে বোঝায়-
> বাঙলা তথা বৃটিশ ভারতের বৃহত্তম জেলা ময়মনসিং।
> ডাকা (ঢাকা) জেলা।
> পূর্বতন বাখরগঞ্জ জেলা (সুপ্রাচীন চন্দ্রদ্বীপ নামে খ্যাত) ও পরবর্ত্তীকালের বরিশাল জেলা।
> শ্রীভূমি বা শ্রীহট্ট জেলা।
> পূর্বত্ন ভুলুয়া-উদ্ভূত নোয়াখালি জেলা।
> ফরিদপুর জেলা।
> চট্টগ্রাম জেলা.
লেখস্বত্ব © ২০২০ আমরা বাঙালী - সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত।