হিন্দী, উর্দু সাম্রাজ্যবাদীদের পাহারাদার রাজনৈতিক দলগুলি সবাধীনতার ঊষালগ্ন থেকেই বাঙলা ভাষা-সংস্কৃতির অবদমনের ক্ষেত্র ও কৌশল অবলম্বন ক’রে চলেছে ।১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এর মধ্যে দেশ ভাগের বলি হয়ে কয়েক কোটি বাঙালীকে আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, উড়িষ্যা, অসম প্রভৃতি রাজ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়। তাঁদের জন্য নামমাত্র প্রাথমিক বা কোথাও কোথাও মাধ্যমিক বিদ্যাল্যের ব্যবস্থা হয়েছিল কিন্তু বাংলা ভাষায় পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষকের যথাযথ ব্যবস্থা হয়নি।
১) আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে ২৫ টে বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়কে, ভারত সরকারের এন,সি,ই,আর,টি বিভাগ ১৯৫৫ সাল থেকে বাংলা পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষকের ব্যাবস্থা না ক’রে হিন্দী ও তামিল মাধ্যমে রূপান্তরিত করেছে।
২) মণিপুর জিরিবাম জেলার ৫৬টি প্রাথমিক ও মাধ্যমিকস্তরীয় বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয় ‘মিতেই’ মাধ্যমে রূপান্তরিত হয়েছে।
৩) ঝাড়খন্ডের গড় ৭০% মানুষ বাঙালী, সেখানকার সমস্ত বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয় হিন্দী মাধ্যমে রূপান্তরিত হয়েছে। ঝাড়খন্ডের সরকারী কাজের ভাষাও হিন্দী।
৪) খোদ পশ্চিমবঙ্গের সরকারী ও বেসরকারী কাজ-কর্ম বাংলা ভাষায় হয় না। একদিকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলিতে ইংরাজী ভাষার উপর যত্নশীল না হওয়ার জন্য অভিবাবকদের কাছে বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলি গুরুত্ব হারাচ্ছে, কমছে ছাত্র-ছাত্রা সংখ্যা, বন্ধ হচ্ছে বাংলা মাধ্যম স্কুল। অন্যদিকে এই পশ্চিমবঙ্গ সরকারই বাংলার বুকে বাঙালীদের করের টাকাতেই গড়ে তুলছে হিন্দী বিশ্যবিদ্যালয়। কেবল রাজনৈতিক স্বার্থে এমন যুক্তিহীন সিদ্ধান্ত বাঙালী জাতির প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
৫) জাতীয় সংহতির প্রতীক ‘কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়’ গুলিতে বাংলা ভাষা পড়ানো হয় না। পূর্বের ‘ত্রি-ভাষা সুত্র’ বন্ধ করে, হিন্দী-ইংরাজীর সঙ্গে একটি ভারতীয় ধ্রুপদী ভাষা (ক্লাসিকাল ল্যাঙ্গুয়েজ) পড়ানোর ফরমান জারী করা হয়েছে। অথচ পৃথিবীর চতুর্থ (মতান্তরে পচ্চম/ষষ্ঠ) সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষা, পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর ভাষা, এশিয়ার একমাত্র নোবেল জয়ী ভাষা্, ভারতবর্ষের সবথেকে বেশী শব্দভান্ডারের অধিকারী ভাষা ও ভাষা-বিজ্ঞানের বিচারেও অনেক উন্নত ভাষা- বাংলা ভাষা ভারত সরকারের বিচারে ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি পায়নি।
৬) দক্ষিণ ভারতের একাধিক ভাষায় কেন্দ্রীয় সরকারী-বেসরকারী অফিসে, ব্যাঙ্কে কাজ কর্ম সংক্রান্ত ফর্ম-পত্রাদি আঞ্চলিক ভাষায় ছাপা হচ্ছে; পশ্চিমবঙ্গে হয় না।
৭) ভারতের সংবিধান স্বীকৃত ২২ টি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা ভারতের সংবিধান দিয়েছে। অথচ ভারত সরকার সংবিধানকে অমান্য করে কেবল হিন্দী ভাষাকেই রাষ্ট্র ভাষা করার চক্রান্ত ক’রে চলেছে। ভারত সরকারের রেলবিভাগের কর্মচারীদের মধ্যে হিন্দী রাষ্ট্রভাষা প্রচার করে হিন্দী ভাষা সেখান হয়। এমনকি সরকারী-বেসরকারী বিদ্যালয়ে ছোটদের হিন্দীকে রাষ্ট্রভাষা পড়ানোও হয়।
৮) কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তথা কেন্দ্রীয় সরকারী দপ্তর সমূহে, ত্রিভাষা সূত্র মেনে প্রতিটি সরকারী কাজে হিন্দী ও ইংরাজীর পাশাপাশি প্রাদেশিক ভাষাকেও সমান গুরুত্ব দেওয়াটাই আইনসিদ্ধ। ১৯৮৬ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী ত্রি-ভাষা সূত্র পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়, জওহর নবোদয় বিদ্যালয়, সৈনিক স্কুল, অ্যাটোমিক এনার্জী স্কুল, রেল ও অন্যান্য দপ্তর পরিচালিত বিদ্যালয়ে মানা হয় না।
এ সমস্ত বিদ্যালয়ে ভর্তির সময়ে, অভিভাবকদের প্রাদেশিক ভাষা অর্থাৎ বাংলা ভাষা পড়ার ফর্ম দেওয়াই হয় না; আর অভিভাবকরাও চান না; ফলে বাংলার জন্য শিক্ষক নিয়োগই হয় না। এমনই একটি ধারণা গড়ে তোলা হয়েছে যে, এসব বিদ্যালয়ে বাংলা পড়া যায় না।
৯) ন্যাশানাল ইনসটিটিউট অফ ওপেন স্কুলিং ( NIOS ) মুক্ত বা দূরশিক্ষায় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রদান করে। ইংরাজী, হিন্দী, মারাঠী, তেলেগু, ওড়িয়া ইত্যাদি ভাষায় পাঠ্য পুস্তক ও পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ছাপা হয়, পরীক্ষার উত্তরও দেওয়া যায়, কিন্তু বাংলা সেখানে উপেক্ষিত।
১০) কেন্দ্রীয় সরকারের সুস্পষ্ট নির্দেশিকা থাকা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে কোন কেন্দ্রীয় সরকারী কার্যালয়, ওয়ার্ক শপ, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ইত্যাদিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয় না। ২১শে ফেব্রুইয়ারী পালিত হয় না।
১১) সারা ভারতবর্ষে ডাক্তারী পড়ার জন্য অভিন্ন জয়েন্ট পরীক্ষায় (নীট-NEET), মাতৃভাষাকে কোমাচ্ছন্ন করার আর একটি চক্রান্ত। ৯ই মে ২০১৬-তে সুপ্রীম কোর্ট ডাক্তারি-শিক্ষায় রাজ্যস্তরের জয়েন্ট বন্ধ ক’রে সারা দেশে অভিন্ন জয়েন্টের নির্দেশ দিয়েছে। জয়েন্টের ভাষা হবে ইংরাজি ও হিন্দী। বাংলা মাধ্যমে পড়ার ছেলে-মেয়েদের কাছে সিলেবাসও হবে আলাদা, ভাষার মাধ্যমও হবে আলাদা।
১২) পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধিনস্ত সমস্ত সরকারী ও বেসকারী চাকুরির পরীক্ষায় বাংলা ভাষায় একটি প্রশ্নপত্র বাধ্যতামূলক ভাবে না থাকায় ভারতের অবাঙালীরাও ইংরাজি, কোথাও কোথাও হিন্দীতে উত্তর লেখার সুযোগ পেয়ে বাঙলার মাটিতেই বাঙালীর চাকুরীতে ভাগ বসাচ্ছে। কেবল মাত্র রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এ হেন অযৌক্তিক সিদ্ধান্তে বাঙলার মাটিতে বাঙালীরাই বঞ্চিত হচ্ছে।
লেখস্বত্ব © ২০২০ আমরা বাঙালী - সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত।