'প্রাউট' দর্শনের পথানুসারী "আমরা বাঙালী" সংঘটন, এক ও অবিভাজ্য শোষণমুক্ত মানব সমাজ ঘটনের লক্ষ্যে বিশ্বাসী। 'প্রাউট' বিশ্বের প্রতিটি মানুষের ভূমা (Cosmic) উত্তরাধিকার (Inheritance) স্বীকার করে ; বিশ্বের মানব জগৎ, প্রাণী ও উদ্ভিদ বা অচেতন জগতের প্রত্যেকের অস্তিত্ত্ব রক্ষা তথা সার্বিক বিকাশের লক্ষ্যে অবিচল।
অখন্ড মানব সমাজের অংশীদার বা সদস্য হিসেবে, কোন দেশ, রাষ্ট্র বা এলাকা বা সমাজ অথবা, সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চল (Socio-economic Unit/Zone)-এর সদস্যভুক্তি বা অংশীদারিত্ব অথবা নাগরিকত্বের প্রশ্নে, প্রাউট দর্শনের পথানুসারী "আমরা বাঙালী" সংঘটন -
(ক) মানসিক ও আধ্যাত্মিক জগতে, প্রতিটি মানুষের ভূমা নাগরিকত্ব বা সদস্যভুক্তি (Cosmic Citizenship)-কে সমর্থন করে, তথা
(খ) জাগতিক/ভৌতিক ক্ষেত্রে, প্রতিটি মানুষের সমাজ-ভিত্তিক নাগরিকত্ব বা সদস্যভুক্তি (Samaj/Socio-economic Zone-wise Citizenship)-এর নীতি স্বীকার করে।
কোন দেশ, রাষ্ট্র বা সমাজের সদস্য বা সাধারণভাবে বসবাসকারীদের তালিকা (NPR/জাতীয় জনসংখ্যাপঞ্জি) ও নাগরিকদের রেকর্ড বা তালিকা (NRC/নাগরিকপঞ্জী) তৈরি করা সংশ্লিষ্ট এলাকার সরকারের এক্তিয়ার বা অধিকারের মধ্যেই পড়ে ; নাগরিকদের প্রাপ্য অধিকার বা সুযোগ-সুবিধা প্রদান তথা, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে নাগরিক তালিকার যথেষ্ট প্রয়োজনও রয়েছে ; তবে সে তালিকা কোন মনুষ্য-সৃষ্ট জাতি-ধর্ম-বর্ণের বিচারে অবশ্যই নয়, ব্যষ্টির শারীরিক অস্তিত্ত্ব (Physical Identity)-র ভিত্তিতেই হওয়া কর্তব্য। আর প্রব্রজনকারী(Refugee)-দের সদস্যভুক্তি বা নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়টিও (CAA'19), বহুমুখী কারণে সংশ্লিষ্ট সরকারেরই বিবেচনার বিষয়। এ বিষয়গুলিতেও প্রাউট দ্বি-মত পোষণ করে না।
এবারে, প্রাউটের দৃষ্টিতে বাঙলা তথা ভারতের সর্বত্র প্রযোজ্য, চলতি NPR, NRC ও CAA'19 প্রক্রিয়ার মুল্যায়ন করা যাক। ধর্মমত নয়, প্রাউট মানুষের শারীরিক পরিচয়ের ভিত্তিতেই সদস্যভুক্তি বা নাগরিকত্বের পক্ষে কথা বলে। "ক্যা'১৯" ধর্মমতের ভিত্তিতে তথা ভারতের সংবিধানের মৌল নীতিবিরুদ্ধ নাগরিকত্ব প্রদানমূলক একটি আইন --- যা প্রাউট আদৌ সমর্থন করে না॥ দ্বিতীয়ত: প্রাউট সমাজভিত্তিক অর্থাৎ সামাজিক-অর্থনৈতিক ইউনিট বা অঞ্চলভিত্তিক (Socio-economic Zone-wise) নাগরিকত্বে বিশ্বাসী। সে পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালী মাত্রেই "বাঙালীস্তান"-চিহ্নিত সমাজের সদস্য বা নাগরিক ; সুতরাং প্রাউটের মতে, ভারতের প্রতিটি বাঙালীর নিঃশর্ত নাগরিকত্বই কাম্য ও দাবী হওয়া উচিত। প্রাউট ভারত-ভূখন্ডে ৪৪টি সুচিন্তিত জীবতাত্ত্বিক এলাকা, বা সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চলের মাধ্যমে নব্যমানবতাবাদী মানব সমাজ ঘটনের রূপরেখার প্রচারক। প্রাউটের আদর্শে অনুপ্রাণিত "আমরা বাঙালী" সংঘটন, এ মুহূর্তে পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও তৎ সন্নিহিত সমস্ত বাংলাভাষী এলাকা ( যা মূলতঃ বাঙলারই অংশ ) নিয়ে বাঙালীস্তান-নামক সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চল বা ইউনিট ঘটনের দাবী নিয়ে আন্দোলন করে চলেছে।
স্বাধীনতার ঊষাকালে তৎকালীন তদারকি ভারত সরকার, মুখ্যতঃ পশ্চিম পাকিস্তান-আগত সংখ্যালঘু পঞ্জাবী, শিখ, সিন্ধী, গুর্জ্জ্বর, বালুচ ইত্যাদি উদ্বাস্তুদের ১৯৪৯ সালের মধ্যে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় নিঃশর্ত, এককালীন নাগরিকত্ব ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিল; বাঙালীরা বঞ্চিত হয়েছিল, কারণ খুব অল্প সংখ্যক চতুর, শিক্ষিত, সচেতন বাঙালী সংখ্যালঘুরা ততদিনে অর্থাৎ ১৯৪৯ সালের মধ্যে, উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে আসতে পেরেছিল ; সিংহভাগ সংখ্যালঘু বা অন্যান্য অশিক্ষিত, অসচেতন, গরিব-মধ্যবিত্ত বাঙালীরা হয় তখনই দেশত্যাগের কথা ভাবেন নি, বা ভাবলেও বাপ-ঠাকুরদার ভিটে-মাটি ছেড়ে, সম্পূর্ণ অনিশ্চিতের পথে পা বাড়ানোর মত আর্থিক সঙ্গতি তাঁদের ছিল না বলেই, ১৯৪৯ সালের মধ্যে দেশান্তরিত হ'তে পারেন নি। মোটামুটি বিচারে ১৯৫০ সালের নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি স্বাক্ষরিত হ'বার পূর্বে মাত্র ৫৩ লক্ষের কাছাহাছি বাঙালী উদ্বাস্তু ভারতে এসেছিল।
এমতাবস্থায় ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারিতে নোতুন সংবিধান গৃহীত হবার পরপরই, মাত্র আড়াই মাসের মধ্যে ৮ই এপ্রিলে স্বাক্ষরিত হয়েছিল ভারত-পাকিস্তান চুক্তি (নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি) ; যার দোহাই দিয়ে ভারত সরকার, পূর্ব পাকিস্তানের অত্যাচারিত/ভীত/সন্ত্রস্ত সংখ্যালঘুদের উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে আসতে নিরুৎসাহিত করেছিল ; এমনকি প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু তাঁর মন্ত্রিসভার দু'জন মন্ত্রী চারুচন্দ্র বিশ্বাস ও অনিল কুমার চন্দকে পূর্ববঙ্গের সংখ্যালঘু এলাকায় পাঠিয়ে, তাঁদেরকে ভারতে না আসতেও ব্যাপক প্রচার চালিয়েছিল ; বলা হয়েছিল, চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তান সরকার সংখ্যালঘুদের জীবন-জীবিকা, সম্পত্তি, সম্ভ্রম রক্ষা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ; উদ্দেশ্য ছিল সংখ্যালঘু বাঙালীদের উদ্বাস্তু হয়ে তক্ষুনি ভারতে না আসার জন্য বোঝানো ও নিরস্ত করা। বাঙালীদের আশ্বস্ত করে বলা হয়েছিল, ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে তাঁরা অবশ্যই ভারতে স্থান পাবেন। বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য, ভারতের জাতীয় নেতৃবৃন্দ [ মহাত্মা গান্ধী/ জওহরলাল নেহেরু/ সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল/ ড: রাজেন্দ্র প্রাসাদ প্রমুখ ] সেদিন উদাত্ত কণ্ঠে প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছিলেন যে, ভবিষ্যতে যেদিন দেশভাগের বলি বাঙালীরা দেশত্যাগ করে ভারতে আসতে বাধ্য হবেন, তাঁদের সাদরে গ্রহণ করা হবে। বাঙালীরা আশ্বস্ত হয়েছিল ; তাঁরা দেশত্যাগ করতে চায় নি ; কিন্তু নেহেরু-লিয়াকত চুক্তির অব্যবহিত পর থেকেই বিক্ষিপ্ত ভাবে দফায় দফায়, পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা, খুন, লুটতরাজ-কবলিত বা ভীত-সন্ত্রস্ত বাঙালীরা ভারতে আশ্রয় খুঁজতে বাধ্য হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে উর্দু বনাম বাংলা অর্থাৎ জাতিসত্ত্বাগত অস্তিত্ত্ব-বিকাশের স্বাধীনতার প্রশ্নে, স্বাধীন বাঙলাদেশ ঘটনের পূর্বে ও পরে, জীবনের দায়ে বাঙালীরা ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কি ঘটেছিল তারপর....!?
১৯৫০ সালের ৮ই এপ্রিলের পরে ভারতে দেশান্তরিত পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের সঙ্গে, সেদিনের ভারত সরকার যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, সে ইতিহাস প্রতিটি বাঙালীর অতি অবশ্যই জানা উচিত। নেহেরু-লিযাকত চুক্তির পূর্বে আসা দেশভাগের বলি বাঙালী উদ্বাস্তুদের মাত্র ৫২.১৪ লক্ষকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল ; আর চুক্তি-পরবর্তী কালের দেশান্তরিত উদ্বাস্তুদের আদৌ স্বীকৃতিই দেয় নি মহান ভারত সরকার ; সুতরাং নিঃশর্ত নাগরিকত্ব তো বিশ বাও জলে !!
কেন্দ্রীয় সরকার প্রকাশিত "দি স্টোরি অফ রিহ্যাবিলিটেশন (The Story of Rehabilitation)" গ্রন্থে প্রাপ্ত তথ্যে প্রকাশ, বাঙালী উদ্বাস্তুদের দু'টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে - (ক) বৈধ বাস্তুত্যাগী, ও (খ) অবৈধ বাস্তুত্যাগী। "বৈধ
বাস্তুত্যাগী"-দের সংখ্যা হিসাবে বলা হয়েছে, ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এই সংখ্যা ৫২.১৪ লক্ষ ; আর "অবৈধ বাস্তুত্যাগী" সম্পর্কে বলা হয়েছে, "এই সংখ্যা বিরাট"॥ প্রকৃতপক্ষে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের মোট সংখ্যা দেড় থেকে দু'কোটির মধ্যে। ভারত সরকার অবৈধ বাস্তুত্যাগী বাঙালী উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনও দেয় নি, সঠিক সংখ্যাও স্থির করার প্রয়োজনও বোধ করে নি॥
বাংলা ও বাঙালীর এ হেন ঐতিহাসিক বঞ্চনার প্রেক্ষাপটে, শর্তাধীন, বিধি-নিষেধ ও পদ্ধতির বেড়াজালে ঘেরা "ক্যা'১৯" আইন, প্রকৃতপক্ষে সাত থেকে পাঁচ দশক ধরে ভারতে বসবাসকারী কয়েক কোটি (হতে পারে, ৪/৫/৬ কোটি) বাঙালী নাগরিককে আইনগত ভাবে বিদেশী বা অধিকারহীন করার এক জাতীয় চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা। এ আইন নাগরিকত্ব বা অনুপ্রবেশকারী সমস্যা ও বিপদের কোনটারই সমাধান করবে না॥
একমাত্র সমাধান, বাঙালীদের চাই "আবেদনহীন, ঝঞ্ঝাবিহীন, এককালীন, নিঃশর্ত নাগরিকত্ব আইন"। সেজন্য "সিএএ'১৯" বাতিল করার দাবী নয়, পুনঃরায় "সিএএ'১৯" আইনের যথোপযুক্ত সংশোধন চাই ; "সিএএ'১৯" পুনরায় সংশোধনের পরে হবে এনপিআর/এনআরসি ।
এন.পি.আর বা এন.আর.সি হোক প্রাউটের সমাজ আন্দোলনের নীতির ভিত্তিতে এবং ভারতের সাংবিধানিক চৌহদ্দির মধ্যে। তাই এককালীন নিঃশর্ত নাগরিকত্বের দাবী আমরা বাঙালীর রাজনৈতিক লাইন। হিন্দী-উর্দু সাম্রাজ্যবাদীদের পাহারাদার ভারত সরকার, ১৯৫০ সালের পরে পাকিস্তান ও ১৯৭১-পরবর্তী স্বাধীন বাঙলাদেশ ঘটনের মুক্তিযুদ্ধের কাল থেকে, ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী ও বসবাসকারী, অত্যাচারিত বাঙালীদের নাগরিকত্ব প্রদান ঝুলিয়ে রেখেছে। আজ তাঁদের শর্ত, বিধি-পদ্ধতি আরোপিত নাগরিকত্বের আশ্বাস দিয়ে, এনপিআর/এনআরসি-র মাধ্যমে অধিকারহীন করার সুদূরপ্রসারী চক্রান্ত চলছে।
সেজন্য "আমরা বাঙালী" সংঘটনের সুস্পষ্ট দাবী হল, "বাঙালীদের বাসস্থান ও নাগরিকত্ব নিয়ে, স্বাধীনোত্তর ৭৩ বছরের পুঞ্জীভূত বঞ্চনা দূর করতে, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশভাগের বলি প্রতিটি বাঙালীকে প্রথমে এককালীন, নিঃশর্ত নাগরিকত্ব দিতে হবে ; অর্থাৎ "সিএএ'১৯ (CAA'19)" পুনঃরায় যথাযোগ্য ভাবে সংশোধন করে, বাঙালীদের নিঃশর্ত নাগরিকত্ব আইন পাশ করতে হবে ; তারপরে এনপিআর (NPR) ও এনআরসি (NRC) অদ্যতন করতে হবে।
‘আমরা বাঙালী’-র এই দাবীটি বঞ্চিত বাঙালীর প্রতি কোনও মিথ্যা প্রতিশ্রুতিজনিত বা আবেগসর্বস্ব বাগাড়ম্বরতা নয়। অর্থনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে যা ‘আমরা বাঙালী’-র অন্যতম প্রধান দাবী, বেকার বাঙালী যুবক-যুবতীদের সার্বিকভাবে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। এটা বিজ্ঞানসম্মত ভাবেই করা সম্ভব। প্রথম ধাপে পূঁজির সঞ্চয়ে লাগাম দিতে হবে। যদি কোনও একটি এলাকায় (একটি ব্লক) মানুষের নূন্যতম ক্রয়ক্ষমতার পরিমাণ ৫০ টাকা হয় ও মানুষের সংখ্যা যদি ১০০ হয় তাহলে মোট অর্থনীতির পরিমাণ দাঁড়ালো ৫০০০ টাকা। এই মোট পরিমাণ কোনও একটি ব্লকে বেশি থাকতেও পারে আবার কমও থাকতে পারে। কিন্তু ১০০ জনেরই নূন্যতম ক্রয়ক্ষমতা ৫০ টাকা নেই। যেখানে নেই সেখানে কাজের পরিবেশ তৈরী ক’রে নিজ যোগ্যতায় কাজ পাওয়ার প্রেক্ষিত তৈরী ক’রে ১০০% মানুষকেই কর্মসংস্থান দিতে হবে। অথবা সামাজিক সুরক্ষার কথা ভেবে তাঁদের নূন্যতম ক্রয়ক্ষমতা প্রদান করতে হবে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার জন্য-তবে লক্ষ্য হবে নিজ পরিশ্রমের বিনিময়ে অর্জন করার প্রেক্ষিত দান। যেখানে মোট অর্থনীতির পরিমাণ বেশি সেখানে সঞ্চয়ে লাগাম পড়িয়ে উদ্ধৃত অর্থ গুনানুপাতে বন্টন ক’রে ১০০% মানুষকে কর্মসংস্থান দিতে হবে।
লেখস্বত্ব © ২০২০ আমরা বাঙালী - সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত।