প্রাউট দর্শন হ’ল পৃথিবীর মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম কোন সমাজ-অর্থনৈতিক দর্শন যার ভিত্তি হ’ল আধ্যাত্মিকতা। এর আগে মানব ইতিহাসে যতগুলি দর্শন এসেছে সেগুলি সাধারণত-ব্যষ্টি কেন্দ্রীক (Self centered) কিংবা জড় কেন্দ্রীক (Matter centered) কিংবা ভাবজড়তা কেন্দ্রীক (Dogma centered)।
প্রাউটের উদ্দেশ্য সর্বাত্মক শোষনমুক্ত সমাজ গড়াতো বটেই, তার সাথে সাথে মানুষকে তার মনুষ্যত্বের বিকাশের মধ্যে দিয়ে তার পূর্ণতা অর্জনে প্রতিষ্ঠিত করাও এর উদ্দেশ্য। কারণ কেবল মাত্র জাগতিক দুঃখ-দুর্দশা দূরীকরণেই মানুষের প্রকৃত মুক্তি আসে না। প্রকৃত মুক্তি আসে মানুষের ব্রহ্মত্ব লাভের সাথে। মানুষের জীবনের এই স্থায়ী সমাধান করতে একমাত্র ঈশ্বর কেন্দ্রীক (God centered) দর্শনই সক্ষম, আর প্রাউট তাই-ই।
প্রাউট হ’ল একটি পূর্ণাঙ্গ সমাজ দর্শন, অর্থাৎ এতে মানব সমাজের যত ধরণের সমস্যা রয়েছে সবগুলির কথা ভাবা হয়েছে। মার্কসবাদ, ধনতন্ত্র প্রভৃতি অন্যান্য সমাজদর্শন কিন্তু পূর্ণাঙ্গ দর্শন নয়। ওগুলি আংশিক বা খন্ড দর্শন, সমাজের সমস্ত সমস্যার সমাধানের উপায় এগুলিতে নেই। আর এটাই এই দর্শনগুলির ব্যর্থতার অন্যতম কারণ। যেমন অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দুর্নীতি একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। একটা উন্নত আদর্শও ব্যর্থ হেয় যায় এই দুর্নীতির কারণে। অথচ, কেমন ক’রে মানুষকে সৎ, নীতিবান করা যায়- সে সম্পর্কে ওই সমস্ত খণ্ডদর্শনগুলিতে কিছুই বলা নেই। কিন্তু প্রাউটে এই দিকটাকে উপেক্ষা ক’রা হয়নি।
এই ধরণের তত্ত্বগুলির গঠন পদ্ধতির বিচারে দু-ভাগে ভাগ করা যায়। (১) প্রয়োগ-ভৌমিক তত্ত্ব ও (২) সৈদ্ধান্তিক তত্ত্ব। প্রয়োগ-ভৌমিক তত্ত্ব বাস্তব জগৎকে পর্যবেক্ষণ ক’রে তাকে অনুধাবন ক’রে তৈরি করা হয়। এ ধরণের তত্ত্বকে ঠিক মত চেষ্টা করলে বাস্তবায়িত করা মোটেই অসম্ভব নয়। কিন্তু বাস্তব জগতের দিকে না তাকিয়ে কেবল মনে মনে কল্পনা ক’রে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় তাকে বলা হয় সৈদ্ধান্তিক তত্ত্ব। এই ধরণের সৈদ্ধান্তিক তত্ত্ব বাস্তবায়িত না হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই সমস্ত সৈদ্ধান্তিক তত্ত্ব চার ধরণের মনস্তত্ত্ব থেকে সৃষ্ট হয়। এই চার ধরণের মনস্তত্ত্ব হ’ল- ক)ভন্ড মনস্তত্ত্ব (Hypocrite Psychology), খ) তাত্ত্বিক মনস্তত্ত্ব (Utopean Psychology), গ) প্রয়োগ ক্ষেত্রে সাংঘটনিক অসুবিধা (Organisationl difficulty) ও ঘ) পরিবেশ গত অসুবিধা (Environmental difficulty)। কিন্তু যা প্রয়োগভৌমিক তত্ত্ব- যা বাস্তবকে পর্যবেক্ষণ ক’রে তৈরী করা হয়, তা বাস্তবায়িত হবেই। ‘প্রাউট’ হচ্ছে এই ধরণের প্রয়োগভৌমিক তত্ত্ব।
প্রাউট-প্রবক্তা এই প্রয়োগভৌমিক তত্ত্ব সম্পর্কে বলেছেন- “প্রথমে বাস্তব জগৎকে পর্যবেক্ষণ ক’রে তাকে অনুধাবন করা হ’ল। তারপর সিদ্ধান্ত তৈরী করা হ’ল। উদাহরণ, আপেল মাটিতে পড়ার পর সিদ্ধান্ত তৈরী হ’ল- সিদ্ধান্ত তৈরী হবার পর আপেল মাটিতে পড়েনি। এইসব ক্ষেত্রে যেখানে সিদ্ধান্ত প্রয়োগভৌমিককে অনুসরণ করে, প্রয়োগভূমি থেকে আত্মপ্রকাশ করে তাকে অল্পায়াসেই বাস্তবে রূপায়িত করা যায়। সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হবে, তবে তা প্রচেষ্টা, সময় ও সংযোগের ওপর নির্ভরশীল, অধিক চেষ্টা হ’লে অল্প সময়েই বাস্তবায়িত হবে।”
পুঁজিবাদ বা মার্কসবাদে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা কেন্দ্রীত (Centralised), অর্থাৎ কেন্দ্র থেকে পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু প্রাউটের অর্থনীতি বিকেন্দ্রীত (Decentralised)। এখানে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ওপর থেকে নীচে নেমে আসবে না, নীচ থেকে ওপরে যাবে। তাই প্রাউটের নীতিতে প্রথমে প্রতি ব্লকে ব্লকে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা তৈরী করতে হবে। এক একটি ব্লকে কী কী সম্পদ আছে তার একটি সমীক্ষা করে তদানুযায়ী অর্থনৈতিক পরিকল্পনা তৈরী করতে হবে ও সেই ব্লকের মানুষদের কর্মসংস্থান করতে হবে। এই পরিকল্পনা ব্লকের ভেতরে (Intra block) যেমন হবে, তেমনি প্রয়োজনে কয়েকটি ব্লককে নিয়ে (Inter block) পরিকল্পনাও গ্রহণ করতে হবে। বিকেন্দ্রীত অর্থনীতিতে স্থানীয় কাঁচামাল স্থানীয়দের হাতেই থাকবে, ফলে অর্থের বহিঃস্রোত বন্ধ হবে। কমবে শোষণের সম্ভবনা।
লেখস্বত্ব © ২০২০ আমরা বাঙালী - সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত।