গোর্খাল্যান্ডের দাবী একটি বিশেষ জাতিগোষ্ঠির কোনো পৃথক রাজনৈতিক আন্দোলন নয়, এটা ভারতের অবিভক্ত কম্যুনিষ্ট পার্টি আর তার দালালদের দ্বারা প্রাথমিকভাবে সৃষ্ট একটা কৃত্রিম ব্যাপার। ১৯৭৭ সালে মার্ক্সবাদীরা গোর্খাদের মধ্যে একটা আবেগ তৈরী করে, তাদের দিয়ে গোর্খাদের স্বশাসন ও গোর্খালী ভাষার স্বীকৃতির নামে এই দাবী চাগিয়ে তুলেছিলেন। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করা। সেই নির্বোধ আর সংকীর্ণমনা রাজনৈতিক নেতারা এটা তখন বুঝতে পারে নি যে, তাদেরই সৃষ্ট এই দাবী ও আন্দোলন একদিন তাদেরই উপর বুমেরাং হয়ে আঘাত করবে। বিস্ময়করভাবে সেই কম্যুনিষ্টরাই এখন নিজেদের রোপিত বিষবৃক্ষকে অন্যের ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের কৃতকর্মের দায়কে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তাদের স্বভাবগত ধূর্ততার সাহায্যে তারা পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে ভুল বঝানোর চেষ্টা করেছে যে এটা কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যাপার। আর তারাই নাকি এই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের উতসাহদাতা।
১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িক ও বিচ্ছিন্নতাবাদী মুসলিম লিগের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এই কম্যুনিস্ট পার্টিই বাঙলাকে বিভক্ত করার শ্লোগান তুলেছিল। সেই সময়েই তারা গোর্খাদের জন্য পৃথক ভূমির শ্লোগানও দিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে এই ‘গোর্খাল্যান্ড’ শব্দটি ১৯৪৭-৪৮ সালে কম্যুনিস্টদের দ্বারা উদ্ভব হয় আর তারা দাবী করেছিল যে সিকিম, নেপালের অংশবিশেষ আর উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং সহ কয়েকটি জেলা নিয়ে এই গোর্খাল্যান্ড ঘটিত হোক। এটা হবে গোর্খাদের নিজস্ব বাসভূমি। এই গোর্খাল্যান্ড দাবীর মাধ্যমে কম্যুনিস্ট পার্টি আসলে গোর্খাদের মধ্যে একটা শক্ত রাজনৈতিক ভিত্তি তৈরী করতে চেয়েছিল; কিন্তু সেই সময়ে এই আন্দোলন ফলপ্রসূ হয়নি।
১৯৭৭ সালে কম্যুনিষ্টরা যখন ক্ষমতায় এল, মার্ক্সিষ্ট কম্যুনিস্ট পার্টি এই পুরোনো গোর্খাল্যান্ডের আবেগকেই পুনর্জাগরিত করল, যা আজ রাজ্যের উত্তরাংশে এক চরম অব্যবস্থা, বিশৃঙ্খলা আর রক্তস্নানের স্থান হয়ে উঠেছে। নিরীহ, শান্তিপ্রিয় সেখানকার বাঙালী অধিবাসীরা দার্জ্জিলিং-এ নিজেদের বাসগৃহ ত্যাগ করে পালিয়ে এল, আর তারা আজ কুচবিহার, জলপাইগুড়ি ইত্যাদি জেলায় বাস করছে। এই ভাবে বাঙালীরা নিজেদের রাজ্যেই উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু বহিরাগত গোর্খারাই দাবী করছে যে বাঙালীরা দার্জিলিং ছেড়ে চলে যাক।
দার্জিলিং-এর মূল আধিবাসী লেপˎচা-ভুটিয়ারা কোচ জাতিভুক্ত। এই কোচেরা আদি বাঙালী। ‘কোচ’ জনসাধারণের একটা অংশ সিকিম ভুটানের সংকোচ নদীর দুই ধারে বসতি স্থাপন করেছিল, আর তাদেরই একটি অংশ বরেন্দ্রভূমি থেকে এসে বাঙলার উত্তরাংশের আরো উত্তরে পর্বত অধ্যুষিত অঞ্চলে বসবাস শুরু করেছিল। লেপˎচা-ভুটিয়ারা বাঙালী জীবন আর সংস্কৃতির মূলস্রোতের সঙ্গে সবসময়ে সম্বন্ধিত থেকেছে। অন্যদিকে গোর্খারা স্পষ্টতই বহিরাগত।
প্রায় দু’শ বছর আগে বাঙলার বাইরে থেকে গোর্খারা জীবিকার সন্ধানে এস দার্জ্জিলিং পার্বতাঞ্চলে বসবাস শুরু করেছিল। ১৮৭২ সালে জনগণনা রিপোর্ট অনুযায়ী সে সময় এদের সংখ্যা এত নগণ্য ছিল যে তাদের সেই রিপোর্টে রেকর্ডভুক্তই করা হয়নি, শুধু এইটুকু উল্লেখ করা হয়েছিল যে তারা বহিরাগত মাত্র। ওই অঞ্চলের উচ্চতর পার্বত্য এলাকায় লেপˎচা আর ভুটিয়ারা বাস করত। সমতলে বাস করত বাঙালীরা।
এছাড়া যারা নেপালী বলে যারা নেপালী বলে পরিচয় দেয় আর দার্জ্জিলিং অঞ্চলে বসবাস করে, তাদের একটা বড় অংশ আদৌ গোর্খা নয়। নেপালীদের পনেরোটি গোষ্ঠী যেমন- তামাং, গুরুং, নেওয়ারী ইত্যাদি দার্জ্জিলিং অঞ্চলে বসবাস করে। তারা গোর্খা নয় আর তাদের ভাষাও গোর্খালী নয়। আসলে গোর্খালী খুবই ছোট একটি গোষ্ঠীর উপভাষা। ভারতীয় ভাষা বলে যেমন কোনো ভাষা বলা যায় না, কেননা ভারতে ৩২৩ টি মুখ্য বা গৌণ ভাষা-আর উপভাষা আছে, আর সবগুলিই ভারতীয় ভাষা। ঠিক তেমনই নেপালে প্রায় ৩২ টি ভাষাআর উপভাষা আছে আর তাদের মধ্যে প্রত্যেকটিই নেপালী ভাষা। গোর্খালী ভাষা ঠিক সেই অর্থে নেপালের রাজভাষাও নয়। এই গোর্খারা এক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর হয়েও তাদের ক্ষুদ্র স্বার্থপূর্তির জন্যে গোর্খাল্যান্ডের দাবী তুলেছিল, আর এই ভাবে তারা দার্জ্জিলিং পর্বতাঞ্চলে বসবাসকারী সরল ও নিরীহ মানুষদের ভুল বোঝাতে শুরু করলেন।
এই গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের পাছনে কোনো ঐতিহাসিক, সামাজিক অথবা আর্থিক যৌক্তিকতা নেই। লেপচা আর ভুটিয়া যারা সেখানকার মাটির সন্তান, তারা গোর্খাদের থেকে সংখ্যায় অনেক বেশী। তাই যারা আজ ‘গোর্খাল্যান্ড গোর্খাল্যান্ড’ বলে চিৎকার করছে ত্রা কেবলমাত্র তাদের হাতকে কলঙ্কিত করে এক বিপজ্জনক রাজনৈতিক খেলায় মেতেছে। ঠিক যেমন গোর্খালীভাষা সংখ্যালঘুদের ভাষা আর তা বৃহদংশের ওপরে কোনোভাবেই চাপিয়ে দেওয়া যায় না, ঠিক তেমনি গোর্খারা দার্জিলিং জেলায় বসবাসকারী অধিবাসীদের মধ্যে খুবই ক্ষুদ্র গোষ্ঠী; আর তাদের এই জন্যেই ওই অঞ্চলে উস্কানির রাজনীতিতে প্রশ্রয় দেওয়া উচিৎ নয়। কিন্তু গ্ত চল্লিশ বছর ধরে এই রাজনীতি লালিত-পালিত হতে দেওয়া হয়েছে, আর গোর্খাল্যান্ডের পেছনে আছে এই গোর্খারাই। এই গোর্খারা সিকিম, ভুটান আর অসম থেকে উঠে এসে এই দার্জিলিং জেলায় একত্রিত হয়েছিল। পশ্চিম বাঙলার বামফ্রন্ট সরকারই জঙ্গল সাফ করে তাদের সেখানে বসিয়েছিল, আর গোর্খালীকে রাজ্যের ভাষার মধ্যে একটি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। তাই মার্ক্সিষ্টরাই গোর্খাদের তাদের নিজস্ব বাসভূমির জন্যে উস্কানী দিয়েছিল। বাঙলার মার্ক্সিষ্টদের বিপজ্জনক আর জঘন্য রাজনীতির এটা নমুনা মাত্র।
ভারতের সাংবিধানিক ব্যবস্থা অনুযায়ী নির্দিষ্ট উপজাতিভুক্ত এলাকাগুলি বিষেশ সাংবিধানিক অধিকার ভোগ করে। অর্থাৎ যেখানে উপজাতিদের অউপযাতিদের দ্বারা পরিচালিত হবার সম্ভবনা রয়েছে, সেখানকার উপজাতিরাই এই সাংবিধানিক অধিকারভুক্ত। এইরকম কয়েকটি উপজাতির উদাহরণ হ’ল গারো, খাসিয়া, কাছারী ইত্যাদি যারা অসম ও মিজোরামের কিছু জেলায় বসবাস করে। ভারতীয় সংবিধানের এই ব্যবস্থা শুধুমাত্র উপজাতিদের জন্য, অন্য কোনো ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর জন্যে নয়। আর এই সুবিধা কেবলমাত্র পূর্বোত্তর ভারতের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, অন্য কোনো অঞ্চলের জন্যে নয়, এমনকি ভারতের অন্যান্য অংশে বসবাসকারী উপজাতিদের জন্যেও নয়। অবশ্য এই সাংবিধানিক অধিকার কোনো দেশে খুব অল্প সময়ের জন্যেই প্রচলিত থাকা বাঞ্ছনীয়।
বাঙলাতেও ঠিক তেমনি দার্জিলিং-এ আজকের জি.টি.এ (গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল এডমিনিষ্ট্রেশন) বা ‘গোর্খা হিল কাউন্সিল’ ভারতীয় সংবিধান বিরোধী, কেননা গোর্খারা উপজাতিভুক্ত নয়। স্বার্থপর কম্যুনিষ্ট নেতা আর গোর্খা প্রধানদের মধ্যে এই সমঝোতা বা চুক্তি শুধু বেআইনীই নয়, অসংবিধানিকও বটে। সংবিধান অনুসারে গোর্খারা কোনোমতেই ‘গোর্খা হিল কাউন্সিল’ বা ‘জি.টি.এ’-র আইনে এই অধিকারভুক্ত হতে পারে না। যারা এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল তারা বিশ্বভাতৃত্বের প্রতিও বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তাই সরকার আর গোর্খাদের এই চুক্তির কোনোভাবেই উপজাতি সম্বন্ধিত হতে পারে না। আর এই দৃষ্টিকোণ থেকেই এটি বেআইনী ও সংবিধান বিরোধী।
লেখস্বত্ব © ২০২১ আমরা বাঙালী - সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত।