দেশভাগের বলি হয়ে ভারতে আসা পাঞ্জাবী ও বাঙালী উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে ভারত সরকার নির্লজ্জ ভূমিকা গ্রহণ করেছে; পাঞ্জাবী ও বাঙালীদের মধ্যে সীমাহীন বৈষম্য তৈরী করেছেন। ইংরেজ বিতাড়নের লক্ষ লক্ষ বাঙালীর আত্মত্যাগ, আত্মবলিদান তথা অগ্রসরতা ও অগ্রেসরতাকে উপহাস ক’রে ভারত সরকার বাঙালী জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
কেন্দ্র সরকারের প্রকাশিত তথ্য (দি স্টোরি অফ রিহ্যাবিলিটেশন – পাতা ১৪৬) থেকে জানা যায় ভারত সরকার বাঙালী উদ্বাস্তুদের দুটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছেন-
১) বৈধ বাস্তুত্যাগী উদ্বাস্তু (১৯৭০ সাল পর্যন্ত সংখ্যা কম-বেশী ৫২.১৪ লক্ষ)
২) অবৈধ বাস্তুত্যাগী উদ্বাস্তু (বলা হয়েছে ‘এই সংখ্যাটা বিরাট’)
বেসরকারী মতে, অবৈধ বাস্তুত্যগী উদ্বাস্তুদের সংখ্যা এক কোটি। অর্থ্যৎ ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ভারতে আগমনকারী বাঙালী বৈধ-অবৈধ উদ্বাস্তু মিলিয়ে মোট সংখ্যা দেড় কোটি । পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তু পরিবারের সংখ্যা ছিল ৯ লক্ষ ৪৩ হাজার। কিন্তু সরকারী নথিপত্রে দেখানো হয়েছে, এই সংখ্যা ১৩ লক্ষ। এই ১৩ লক্ষ পরিবারের মধ্যে এমন অনেক পরিবারকেই ধরা হয়েছে, যারা দেশ ভাগের আগে থেকেই ভারতে বসবাস করছিলেন ও জীবিকায় সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন। উদ্বাস্তু নয় অর্থাৎ পূর্ব পাঞ্জাবেরই অধিবাসী, এমন বহু পরিবারকে সরকারী ব্যয়ে ঘর-বাড়ী, দোকান তৈরী ক’রে দেওয়া হয়েছে।
ভারত সরকারের পুর্নবাসন মন্ত্রকের ১৯৬১-৬২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বণ্টিত সম্পত্তির কিছু তথ্য-
ক) দেশ বিভাগের পর প্রায় সারা ভারতবর্ষে মুসলমানদের পরিত্যক্ত সমস্ত সম্পত্তি, কেন্দ্র সরকার পাঞ্জাবী
উদ্বাস্তুদের মধ্যে বন্টন করেছে।
১) কৃষিজমি- শুধুমাত্র পাঞ্জাবে 60 লক্ষ একর ও অন্যান্য রাজ্যে কয়েক লক্ষ একর।
২) গ্রামাঞ্চলের বাড়ী-ঘর- শুধুমাত্র পাঞ্জাবে প্রায় 7 লক্ষ ও অন্যান্য রাজ্যেও ছিল।
৩) শহরাঞ্চলে ঘর-বাড়ী, দোকান-পাট ৩ লক্ষ পাঁচ হাজার।
খ) এরপরও ভারত সরকারের নিজের খরচায় তৈরী করেছে
১) ২,২১,১১০ বাড়ী ও দোকান ঘর
২) ১৯ টি উন্নত শিল্পাঞ্চল ।
এছাড়াও পাঞ্জাবী উদ্বাস্তুদের জন্যে ভারত সরকার দিল্লীতে ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি উপনিবেশ গড়ে দিয়েছে।১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্ত হয়ে স্বাধীনতা ঘোষিত হবার অল্প দিনের মধ্যে, ভারত সরকার লোক বিনিময়ের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ভারতে আগমনেচ্ছু সমস্ত উদ্বাস্তুদের দেশ বদলের সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাঙালী উদ্বাস্তুদের শীঘ্রাতিশীঘ্র দেশ বদল করে ভারতে আসার জন্য, লোক বিনিময়ের ব্যবস্থা ভারত সরকার আদৌ করেনি। তথাপি "নেহেরু লিয়াকত" চুক্তি পর্যন্ত ৫২.১৪ লক্ষ বাঙালী উদ্বাস্তু ভারতে চলে এসেছ। ১৯৪৯ সালের মধ্যে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ৪৭.৪ লক্ষ পঞ্জাবি উদ্বাস্তুদের সার্বিক পুনর্বাসন সম্পন্ন ক'রে ফেললেও, ৫২.১৪ লক্ষ বাঙালী উদ্বাস্তুদের জন্য ভারত সরকার কিছুই করেনি।
১৯৫০ সালের ৮ই এপ্রিল "নেহেরু লিয়াকত চুক্তি" স্বাক্ষরিত হবার অব্যবহিত পরেই, ভারত সরকার ঘোষনা করল যে, চুক্তির আগে যে সব উদ্বাস্তুরা পাকিস্তান থেকে ভারতে এসেছেন, তাঁরা বৈধ বাস্তুত্যাগী উদ্বাস্ত। যারা পরে এসেছেন তাঁরা অবৈধ বাস্তুত্যাগী উদ্বাস্ত। এ ঘোষনা অনুযায়ী ১৯৫০ থেকে ১৯৭১ এর মধ্যে ক্ষেপে ক্ষেপে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে আসা এক কোটিরও বেশী বাঙালী উদ্বাস্তুকে ভারত সরকার অবৈধ বাস্তুত্যাগী উদ্বাস্ত হিসেবে গণ্য করেছে। তাঁদের কাউকেই নাগরিকত্ব দেওয়া হয়নি । ভারতের প্রশাসন যন্ত্রের সর্বত্র তাঁরা অলিখিত ভাবে 'বিদেশী' বলে উল্লেখিত। এই চক্রান্তের প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে-
১) বাঙালী-বিদ্বেষী হিন্দুস্তানী কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ ও তাদের পরিচালিত ভারত সরকার বাস্তুত্যাগী উদ্বাস্তুদের জন্য সরকারী অর্থ ব্যয় করতে চায়নি।
২) বাঙালী জনগোষ্ঠীর বিপুল অংশের একটা খণ্ডকে কৌশলে ভারতের বিভিন্ন অবাঙালী সমাজের সঙ্গে মিলিয়ে-মিশিয়ে, বাঙালী জাতিসত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন ক'রে ফেলার সুদূরপ্রসারী চক্রান্ত কার্যকর করা ।
৩) বাঙালী উদ্বাস্ত জনগোষ্ঠীর(অবৈধ বাস্তুত্যাগী উদ্বাস্ত) অপর খণ্ডকে সর্বহারা পর্যায়ে নামিয়ে এনে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত করে ফেলার পরিকল্পিত চক্রান্ত কার্যকর করা।
ভারত সরকারের পুনর্বাসন মন্ত্রক 'বৈধ বাস্তুত্যাগী উদ্বাস্ত' বলে যাদের স্বীকৃতি দিল, তাঁদেরও পুনর্বাসন দিল না, এমনকি ক্ষতিপূরণের ব্যাপারটাও সরাসরি অস্বীকার করল। আর "অবৈধ বাস্তুত্যাগী উদ্বাস্ত"-দের প্রসঙ্গে বলা হ'ল, পুনর্বাসন বা ক্ষতিপূরণের কোন প্রশ্নই ওঠে না । কারণ হিসেবে জানানো হয়--- " ১৯৫০ সালের নেহেরু-লিয়াকত চূক্তির বলে বাঙালী উদ্বাস্তুদের পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিতি নিজ নিজ বিষয় সম্পত্তির ওপর তাদের স্বত্বকে বহাল রাখা হয়েছে। সুতরাং বাঙালী উদ্বাস্তুদের ক্ষতিপূরণের প্রশ্নই ওঠে না।"
লেখস্বত্ব © ২০২০ আমরা বাঙালী - সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত।